হাদীস শাস্ত্রের উজ্জ্বল নক্ষত্র শাইখুল হাদীস আজিজুল হক রহঃ
আকাবীরদের জীবনী, (পর্বঃ-চার)
জন্ম ও বংশ পরিচয়
নামঃ আজিজুল হক, উপাধি শাইখুল হাদিস, পিতার নাম আলহাজ এরশাদ আলী। মা হাজেরা বেগম। ১৯১৯ সালে তৎকালীন ঢাকা জেলার মুন্সীগঞ্জ মহকুমার বিক্রমপুর পরগনার লৌহজং থানার ভিরিচ খাঁ গ্রামের সম্ভ্রান্ত কাজী পরিবারে জন্মগ্রহন করেন।
শিক্ষা জীবন
গ্রাম ছেড়ে সাত বছর বয়সে ব্রাহ্মণবাড়ীয়ার জামেয়া ইউনুসিয়ায় ভর্তি হন। মাওলানা শামছুল হক ফরিদপুরী রাহ.’র অধীনে ৪ বছর অধ্যয়ন করেন।
১৯৩১ সালে ঢাকা বড় কাটারা মাদরাসায় ভর্তি হয়ে ১২ বছর অধ্যয়ন করে কৃতিত্বের সাথে দাওরায়ে হাদিস সমাপ্ত করেন। তখন তিনি আল্লামা যফর আহমদ উসমানী, আল্লামা রফিক কাশ্মীরী, হযরত মাওলানা শামছুল হক ফরিদপুরী, হযরত হাফেজ্জী হুজুর রহ. প্রমুখ বিজ্ঞ হাদিস বিশারদদের কাছে কুরআন হাদিসের জ্ঞান লাভ করেন। ১৯৪৩ সালে উচ্চ শিক্ষার জন্য ভারতের বোম্বের সুরত জেলার ডাভেল জামেয়া ইসলামিয়ায় ভর্তি হন। সেখানে মাওলানা শাব্বীর আহমাদ উসমানী রহ. মাওলানা বদরে আলম মিরাঠী রহ. প্রমুখের কাছে শিক্ষা লাভ করেন। সর্বশেষ ভারতের দারুল উলুম দেওবন্দ থেকে মাওলানা ইদরীস কান্ধলবী রহ. এর তত্ত্বাবধানে তাফসীর বিষয়ে উচ্চ শিক্ষা লাভ করেন। এবং তাঁর উস্তাদ মাওলানা শামছুল হক ফরিদপুরী রাহ.’র নির্দেশে ঢাকায় চলে আসেন।
কর্মজীবন
ভারতের ডাভেলে জামেয়া ইসলামিয়ায় উচ্চ শিক্ষা শেষে সেখানে অধ্যাপনার দায়িত্ব নেয়ার আহ্বান জানানো হলেও তার মুরব্বিদের নির্দেশে ঢাকার বড়কাটারা মাদ্রাসায় শিক্ষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। ১৯৫২ সালে লালবাগ মাদরাসার প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে বুখারি শরিফ পাঠ দান করেন। ১৯৭১ সাল থেকে দুই বছর বরিশাল জামিয়া মাহমুদিয়া মাদরাসায় শিক্ষকতা করেন।
১৯৭৮ সালের এপ্রিলে কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড বেফাকের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও প্রথম সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগে ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে বুখারি শরিফের অধ্যাপনা করেন।
এ ছাড়াও জামিয়া মুহাম্মাদিয়া আরাবিয়া মুহাম্মাদপুর, মিরপুর জামেউল উলুম, উত্তরা দারুস সালাম, লালমাটিয়া জামেয়া ইসলামিয়া সাভার ব্যাংক কলোনী ও বনানী জামিয়া ইসলামিয়া মাদরাসায় বুখারি শরিফের পাঠদান করেন। ১৯৭৮ সালে কওমি মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড (বেফাক)-এর প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন।
তিনি লালবাগ কেল্লা জামে মসজিদ, মালিবাগ শাহী মসজিদ ও আজিমপুর স্টেট জামে মসজিদের খতিব ছিলেন। জাতীয় ঈদগাহেও ঈদের ইমামতি করেছেন কয়েক বছর। আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংকের শরীয়া বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন। ১৯৮৮ সালে ঢাকার মুহাম্মাদপুরে সাত মসজিদের পার্শ্বে জামিয়া রাহমানিয়া আরাবিয়া গড়ে তোলেন। এর আগে মালিবাগ জামিয়া শরইয়্যায়ও প্রিন্সিপাল হিসেবে কিছুদিন দায়িত্ব পালন করেন।
রাজনৈতিক জীবন
ছাত্র জীবনেই ইংরেজ খেদাও আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা রাখেন। ভোগ করেন ইংরেজদের নির্যাতন। পাকিস্তান আমলে মাওলানা আতহার আলী, মুফতি শফী প্রমুখের সঙ্গে নেজামে ইসলাম পার্টির কর্মকাণ্ডে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর সে সময় উলামায়ে কেরামের একমাত্র দল জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮১ সালে হাফেজ্জী হুজুরের ডাকে খেলাফত আন্দোলনের নায়েবে আমির হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
ইরান-ইরাক যুদ্ধ বন্ধের জন্য আয়াতুল্লাহ খোমেনী ও প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনের সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনা করেন। ১৯৮৭ সালে তার নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হয় ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন। এ সময় তিনি স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন। ১৯৮৯ সালের ৮ ডিসেম্বর খেলাফত মজলিস প্রতিষ্ঠা করে রাজনীতির ইতিহাসে এক ইতিবাচক পরিবর্তন নিয়ে আসেন শায়খুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হক। ১৯৯১ সালে সমমনা ইসলামী কয়েকটি দল নিয়ে ইসলামী ঐক্যজোট গঠন করেন।
তিনি এর চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তার নেতৃত্বে ইসলামী ঐক্যজোট ১৯৯১ সালে সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে ১টি আসন (সিলেট-৫) লাভ করে। ১৯৯৩ সালে তিনদিন ব্যাপী বাবরী মসজিদ পুনঃ নির্মাণের উদ্দেশ্যে ঢাকা থেকে যশোর বেনাপোল হয়ে অযোধ্যা অভিমুখে ৫ লক্ষাধিক লোকের সমন্বয়ে ঐতিহাসিক লংমার্চের নেতৃত্ব দেন। বাবরি মসজিদ ভাঙার পর ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরসিম রাওকে বাংলাদেশে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেন এবং বিমানবন্দর ঘেরাও কর্মসূচির ডাক দেন। এতে তৎকালীন সরকার ৯ এপ্রিল ১৯৯৩ সালে তাকে গ্রেফতার করে। জনগণের বিক্ষোভের মুখে অবশেষে ৮ মে ১৯৯৩ সালে সরকার শায়খুল হাদিসকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। আজিজুল হক খেলাফত মজলিসের আমির থাকাকালে ২০০৬ সালে আওয়ামী লীগের সঙ্গে বহুল আলোচিত পাঁচ দফা চুক্তি স্বাক্ষর করেন। পরে অসুস্থতার কারণে তিনি আমির পদ ছেড়ে দেন। পরে অবশ্য আওয়ামী লীগের সঙ্গে করা সেই চুক্তি বাতিল হয়।
রচনাবলী
শায়খুল হাদিসের অনন্য অবদান হল, বাংলা ভাষায় ১০ খণ্ডে বুখারি শরিফের প্রথম বাংলা অনুবাদ। তাঁর ছাত্র জীবনেই রচিত ১৮০০ পৃষ্ঠার বুখারি শরিফের উর্দু ব্যাখ্যাগ্রন্থ ‘ফজলুল বারি শরহে বুখারি’ পরবর্তীতে পাকিস্তান থেকে প্রকাশিত হয়। ‘মুসলিম শরিফ ও অন্যান্য হাদীসের ছয় কিতাব’ নামে অনবদ্য এক হাদিসগ্রন্থ সংকলন করেন। এছাড়া মছনবীয়ে রূমীর বঙ্গানুবাদ, পুঁজিবাদ, সমাজবাদ ও ইসলাম, কাদিয়ানি মতবাদের খণ্ডন, মাসনূন দোয়া সংবলিত মুনাজাতে মাকবুল, সত্যের পথে সংগ্রাম এসব বইয়ের রচয়িতাও তিনি। তার প্রতিষ্ঠিত বাংলা ভাষায় ধর্মীয় পত্রিকা ‘মাসিক রাহমানী পয়গাম’ দীর্ঘ দুই যুগ যাবত প্রকাশিত হচ্ছে।
ইন্তিকাল
উপমহাদেশের অন্যতম হাদিস বিশারদ, ইসলামী আন্দোলনের আপসহীন নেতা, বোখারি শরিফের প্রথম বাংলা অনুবাদক, ৫০ বছরের অধিক সময় বুখারি শরিফ পাঠদানের বিরল কৃতিত্বে অধিকারী, ইসলামী ঐক্যজোটের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান বরেণ্য আলেম শায়খুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হক আর নেই। দীর্ঘদিন ধর বার্ধক্যজনিত রোগে ভুগে গত ০৮-০৮-২০১২ ইং বুধবার রাজধানীর আজিমপুরে নিজ বাসায় তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহিরাজিউন। ইন্তেকালের সময় তাঁর বয়স হয়েছিল ৯৩ বছর। তাঁর মৃত্যুতে সারা দেশে শোকের ছায়া নেমে এসেছে।
০৯-০৮-২০১২ বৃহস্পতিবার সকাল ১১টায় জাতীয় ঈদগাহে তাঁর তৃতীয় ছেলে বর্তমান জামিয়া রাহমানিয়ার প্রিন্সিপাল মাওলানা মাহফুজুল হক নামাজে জানাযা পড়ান।
মৃত্যুকালে তিনি পাঁচ ছেলে, আট মেয়ে, নাতি-নাতনিসহ আত্মীয়স¡জন ও অসংখ্যগুণগ্রাহী রেখে গেছেন। দেশ-বিদেশে তার হাজার হাজার ছাত্র রয়েছে। তার পরিবারের ছেলেমেয়ে, নাতি-নাতনিসহ ৭০জন হাফেজ ও ৩০ জন আলেম রয়েছে। তার মৃত্যুতে পরিবারসহ সারাদেশে শোকের ছায়া নেমে এসেছে।
সম্পাদনায় মুফতী ফখরুল ইসলাম নিজামপূরী
পরিচালক: ফিকহে হানাফী রিসার্চ সেন্টার চট্টগ্রাম, বাংলাদেশ।