বিশ্বব্যাপী দ্বীনি কার্যক্রম; প্রতিকূলতা ও সম্ভাবনা”
السلام عليكم ورحمة الله وبركاته
نحمده و نصلى على رسوله الكريم. أما بعد
সিয়ানাহ ট্রাস্ট কর্তৃক আয়োজিত “বিশ্বব্যাপী দ্বীনি কার্যক্রম: প্রতিকূলতা ও সম্ভাবনা’ শীর্ষক আজকের এই অনলাইন সেমিনারে দেশ-বিদেশ প্রবাস থেকে যারা অংশগ্রহণ করেছেন,করবেন সবাইকে মোবারকবাদ জানাচ্ছি।
সেমিনারে মূল বক্তব্যকে আমরা কয়েকটি পয়েন্টে আলোচনা করব ইনশাআল্লাহ —
**(১) শিরোনাম এর যথার্থতা ও সেমিনারের প্রয়োজনীয়তা —
মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নবুয়ত প্রাপ্তির মধ্য দিয়েই দ্বীনি কার্যক্রমের সূচনা হয়েছিল। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দাওয়াত, হিজরত, ও জান মালের কোরবানি, সাহাবায়ে কেরাম, তাবেয়ীন , তাবে তাবেয়িন , আইম্মায়ে মুজতাহিদীন, ফুকাহা, মুহাদ্দিসীন,মুফাসসিরীন ও দ্বীন দরদি মুবাল্লিগিন ও আমাদের আকাবিরদের অক্লান্ত মেহনতের সুবাদে আমরা ইসলাম পেয়েছি। ইসলামের যাবতীয় বিধি-বিধান জানতে পেরেছি।
আমাদের পূর্বসূরিদের অক্লান্ত পরিশ্রমের সুবাদে পুরা দুনিয়াব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছিল ইসলামের বাণী।
এখন দুনিয়াজুড়ে ইসলাম ও মুসলমানদের সার্বিক অবস্থা কী?
তার খবরটুকু আমাদের জানা নেই।
আমরা নিজেদের পরিসরে ব্যক্তিগতভাবে কোনমতে দ্বীন চর্চা করেই পরিতৃপ্ত।
অথচ প্রত্যেক মুসলমানের নৈতিক দায়িত্ব হচ্ছে দুনিয়ার সমস্ত মুসলমানের সার্বিক হালত সম্পর্কে অবগত থাকা।
হযরত নুমান বিন বশীর রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন :
ترى المؤمنين في تراحمهم وتوادهم وتعاطفهم كمثل الجسد اذا اشتكى عضوا تداعى له سائر جسده بالسهر والحمى.
সহীহুল বুখারী ৫৬৬৫
এই হাদীস থেকে আমরা জানতে পারি, দুনিয়ার সমস্ত মুসলমান এক দেহের মত।
একটি দেহের কোন এক জায়গা যখন ক্ষতিগ্রস্ত হয় তখন পুরো দেহে তা অনুভূত হয়। তেমনিভাবে দুনিয়ার কোথাও কোন মুসলমান ক্ষতিগ্রস্ত হলে সমস্ত মুসলমানের অনুভূতিতে নাড়া দেয়ার কথা।
আমরা কেমন যেন হয়ে গেছি। অনুভূতিশূন্য হয়ে পড়েছি।
সিয়ানাহ ট্রাস্টের আজকের এই আয়োজন মুসলিম সমাজের ঘুমন্ত বিবেককে জাগ্রত করার জন্য। দুনিয়ার মুসলমানদের হালাত জানার জন্য।শ্রোতাদের অন্তরে মুসলিম উম্মাহর প্রতি দরদ সৃষ্টির জন্য।
** পৃথিবীজুড়ে দ্বীন চর্চার সমূহ সম্ভাবনা —
১, পৃথিবীর সমস্ত ধর্মের উপর ইসলামকে বিজয়ী করা, শ্রেষ্ঠত্ব দান করা আল্লাহ তাআলার ইচ্ছা। এই লক্ষ্যেই তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে পাঠিয়েছেন।
কুরআনুল কারীমের সূরা সাফ এর আয়াত:
هو الذي ارسل رسوله بالهدى ودين الحق ليظهره على الدين كله ولو كره المشركون.
সুতরাং ইসলাম পৃথিবীর সর্বত্র ছড়িয়ে পড়বেই।
২, ইসলাম একটি উর্বর ধর্ম। পৃথিবীর যেকোন জায়গায় জলে-স্থলে পাহাড়ে পর্বতে ইসলামের বাণী পৌছবেই। মুসলিম নিধন সম্ভব হলেও ইসলাম নিধন কস্মিনকালেও সম্ভব না। বরং মুসলিম নিধনের আয়োজক নিজেই ইসলাম কবুল করে মুসলিম দাঈ হয়ে যেতে পারে।
৩,ব্যক্তিগত জীবন থেকে রাষ্ট্রীয় জীবন, দুনিয়া – আখেরাত, জীবন-মরণ সবকিছুর চূড়ান্ত বিবরণ ও সমাধান রয়েছে ইসলামে।
৪, ইসলাম উত্তম চরিত্রের প্রতি গুরুত্বারোপ করে, মন্দ চরিত্র থেকে বারণ করে। কোন প্রকার অশ্লীলতা বেহায়াপনা বেলাল্লাপনার সুযোগ ইসলামে নেই।
৫, ইসলাম একটি মানবিক ধর্ম। ইসলাম সবার ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করে। সুতরাং ইসলামে অমানবিকতা, ও অধিকার হরণের কোন সুযোগ নেই।
৬, ইসলাম একটি যৌক্তিক ও বিজ্ঞানসম্মত ধর্ম। সুস্থ মস্তিস্ক সম্পন্ন কোন লোক ইসলামের কোন বিধানের উপর আপত্তির সুযোগ পায়নি।
৭, একজন মুসলিমের জন্য সবচেয়ে শক্তিশালী নেয়ামত হচ্ছে, সর্বশ্রেষ্ঠ মোজেজা আল কোরআন। সাথে আছে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব নবীয়ে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আদর্শ সিরাত। যাকে সাথে নিয়ে সফলভাবে দাওয়াতি কাজ পরিচালনা করতে পারে।
এই সমস্ত সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে একজন মুসলিম তৃপ্তির সাথে দ্বীন চর্চা করতে পারে, বুকভরা আশা নিয়ে দাওয়াতি কাজ আঞ্জাম দিতে পারে।
** যেভাবে চলছে দ্বীনি কার্যক্রম —
ক, ব্যক্তিগতভাবে। খ, যৌথভাবে/জামাতবদ্ধ হয়ে। গ, রাষ্ট্রীয় ভাবে।
** যে সকল মাধ্যমে চলছে দ্বীনি কার্যক্রম —
ক,যবানের মাধ্যমে। খ, লিখনীর মাধ্যমে। গ,কর্মের মাধ্যমে।
* যেসকল পন্থা অবলম্বন করে দ্বীনি কার্যক্রম চলছে —
১, ইসলামি বিধি নিষেধ মেনে ব্যক্তিগত আমলের মাধ্যমে।
২, যৌথভাবে شعار اسلام পালনের মাধ্যমে।
৩, মৌখিক বয়ানের মাধ্যমে।
৪, ব্যক্তিগত ও যৌথ দাওয়াতের মাধ্যমে।
৫, তালিম ও তদরিস তথা দ্বীনি ইলম শিক্ষাদানের মাধ্যমে।
৬,তাসনীফ, তালিফ তথা লেখালেখির মাধ্যমে।
৭,তাযকিয়া তথা আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে।
৮,সর্বপ্রকার জুলুমবাজি নিধন ও ইনসাফ কায়েমের মেহনতের মাধ্যমে।
৯, দান অনুদান ও সহযোগিতামূলক কার্যক্রমের মাধ্যমে।
১০, আধুনিক প্রযুক্তির বৈধ ব্যবহারের মাধ্যমে।
** দ্বীন চর্চায় প্রতিকূলতা —
১, মুসলমানদের আভ্যন্তরীণ বিভেদ, গ্রুপিং, ও অনৈক্য।
২, অধিকাংশের ক্ষেত্রে ইসলামের মৌলিক শিক্ষার অভাব।
৩, উম্মতের প্রতি দরদের অভাব।
৪, দারিদ্রতা।
৫, বিলাসিতা।
৬, দাওয়াতি কাজে অনীহা।
৭, দাওয়াতি কাজে সমন্বয়হীনতা।
৮, আত্মমর্যাদা বোধের অভাব।
৯, দাওয়াতের ময়দানে যোগ্য ও প্রশিক্ষিত লোকের অভাব।
১০, উম্মতের বৃহৎ স্বার্থ ভুলে গিয়ে জাতীয়তা,দলান্ধতা , গোত্রপ্রীতিতে লিপ্ত হওয়া।
১১, চারিত্রিক অসঙ্গতি।
১২, বেকারত্ব, অলসতা, সময় নষ্টের অভ্যাস ।
১৩, আল্লাহর ভয় কমে যাওয়া। ব্যাপকভাবে পাপাচারে লিপ্ত হওয়া।
১৪, আধিপত্যবাদী শক্তির জুলুমের শিকার হওয়া।
১৫, জেনে না জেনে অমূলক কাজে অন্যের দ্বারা ব্যবহৃত হয়ে যাওয়া।
** সফলভাবে দ্বীন চর্চায় আমাদের করণীয় –
১, তাওহীদ ও ঈমানের ভিত্তিতে ঐক্যের বন্ধন গড়ে তোলা।
২, ইসলামের মৌলিক শিক্ষা বিস্তারে যুগপৎ ভূমিকা রাখা।
৩, বিশ্বের সমস্ত ইসলামিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে যোগাযোগ ও সমন্বয় তৈরি করা।
৪, পারস্পরিক গীবত, কাদা ছোড়াছুড়ি বন্ধ করে মুসলিম পরিচয় লালন করে সবাই একে অপরের কাছে আসার চেষ্টা করা।
৫, বিলাসিতা পরিহার করে বিশ্বের দরিদ্র মুসলিম জনগোষ্ঠীর পাশে দাঁড়ানো। নিরাশ্রয়কে আশ্রয় দেয়া।
৬, পৃথিবীর অর্ধেকের চেয়েও বেশি হচ্ছেন নারী জাতি। তাই মুসলিম মা বোনদের মধ্যে দাওয়াত ও তালীমের সুব্যবস্থা করা। দ্বীন ইসলামের খেদমতে তাদেরকেও আত্মনিয়োগ করানো।
৭, দাওয়াতের নেশা তৈরি করা।
৮, দাওয়াত ও তাবলীগের কাজে বিভেদ অনৈক্য নয়, বরং সমন্বয় করে জোরালোভাবে কাজ চালিয়ে যাওয়া।
৯, অমুসলিম ভাই-বোনদের কাছে হিকমতের সাথে দ্বীনের দাওয়াত পৌঁছানো, এবং ইসলামের সৌন্দর্য ফুটিয়ে তোলা।
১০, দরিদ্র ও অসহায় নন মুসলিম ভাই বোনদের সহযোগিতা করা।
১১, যোগ্য লোকেরা দ্বীনের দাওয়াত নিয়ে পৃথিবীর আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে পড়া, সফর করা। হিজরতের আমল করা।
১২, নব মুসলিমদের ইসলাম গ্রহণ পরবর্তী সাহায্য সহযোগিতা করা।
১৩, নৈরাশ্যবাদী না হয়ে আত্মমর্যাদাশীল হওয়া।
১৪, দ্বীনের প্রচার ও ইলমের খেদমতে নিয়োজিত ব্যক্তিও প্রতিষ্ঠানগুলোকে সার্বিক সহযোগিতা প্রদান করা।
১৫, ইসলামের মৌলিক বিষয়গুলোর আলোচনা ও চর্চা বাড়িয়ে দেয়া। মতভেদ পূর্ণ বিষয়গুলো সীমিত ও নিয়ন্ত্রিত পরিসরে আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করা।
১৬, ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি একটা জামাত জাগতিক শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়া।
১৭, নিজেকে আল্লাহর কাছে কবুল করিয়ে নেয়া। দ্বীনের জন্য উৎসর্গ করে দেয়া।
১৮, জীবনের সকল মুনাজাতে মুসলিম উম্মাহর ইহ-পরকালীন মঙ্গল কামনায় দোয়া করা।
আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে বুঝার এবং আমল করার তৌফিক দান করুন।